বিশেষ প্রতিনিধি //
সিলেটে গেল প্রায় এক বছর ধরে আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ করছিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা। মুলত বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপের ক্ষমতা, দাপট ও শক্তি বাড়াতে মজুদ করা হচ্ছিল এই অস্ত্রগুলো। ভারতীয় ‘বুঙ্গার চিনি’র ব্যবসা থেকে কামানো কাড়ি কাড়ি কাঁচা টাকা দিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা কিনেন অস্ত্র।
এতোদিন অস্ত্র কেনা ও মজুদের বিষয়টি গল্প-আড্ডায় সীমাবদ্ধ থাকলেও সিলেটবাসী এর প্রকাশ্য রূপ দেখতে পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। গত ১৮ জুলাই নগরীর আখালিয়ায় ও ৪ আগস্ট কোর্ট পয়েন্টে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান ছাত্র-জনতার উপর। এসময় প্রদর্শিত অত্যাধুনিক অস্ত্র দেখে হতবাক হয়ে যান সিলেটের মানুষ।
অভিযোগ উঠেছে, প্রদর্শিত অস্ত্রের মধ্যে এম-১৬ রাইফেলও ছিল। যা সেই সময়কার সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা শিবলু আহমদের হাতে দেখা গেছে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এসব অস্ত্র রাজপথের দখল, প্রভাব বিস্তার ও ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ব্যবহার হলেও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্ত্রধারী সেই ক্যাডাররা হাওয়া হয়ে গেছেন। কোথাও তাদের খোঁজ মিলছে না।
সূত্র জানায়, গেল প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসা চিনির ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সীমান্ত থেকে শহর পর্যন্ত নিরাপদে চিনি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালনে তৈরি হয় বেশ কয়েকটি গ্রুপ-উপগ্রুপের।
‘বুঙ্গার চিনি’খ্যাত এই ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মুলত বিভিন্ন গ্রুপ অস্ত্র কিনে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এই অস্ত্রগুলো এতোদিন বিভিন্ন নেতা ও ক্যাডারের কাছে গোপনে থাকলেও গত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তা প্রকাশ্যে বের হয়। এছাড়া গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েক শ’ নেতা ও পেশাজীবী অস্ত্রের লাইসেন্স বাগিয়ে নেন। লাইসেন্সকৃত অস্ত্রেরও ব্যবহার হয় আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে দমাতে।
সূত্র আরও জানায়, গত ১৮ জুলাই নগরের আখালিয়া এলাকায় পুলিশের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ছাত্র-জনতার উপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসময় অস্ত্র দিয়ে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়েন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট সিলেট নগরের কোর্ট পয়েন্টে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্র-জনতা অবস্থা নিলে তাদেরকে হটাতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা অস্ত্রের মহড়া দেন। তারা অস্ত্র হাতে ছাত্র-জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
পুলিশ ও ক্যাডাররা মিলে কোর্ট পয়েন্ট থেকে ছাত্র-জনতাকে তাড়িয়ে দেন। এরপর আরও কয়েকটি স্থানে ক্যাডাররা অস্ত্রের মহড়া দেন। ৪ আগস্ট কোর্ট পয়েন্টে মহড়ার সময় কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র দেখে হতবাক হন নগরবাসী। সদ্য সাবেক সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য প্রবাসী যুবলীগ নেতা রুহুল আমিন ওরফে শিবলু আহমদের হাতে দেখা যায় অত্যাধুনিক একটি আগ্নেয়াস্ত্র। যেটি অত্যাধুনিক এম-১৬ রাইফেল বলে দাবি করছেন অনেকে।
এছাড়াও আন্দোলন চলাকালীন সময়ে যাদেরকে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে তাদের মধ্যে ছিলেন- সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন খান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি পিযুষ কান্তি দে,মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, মেজরটিলার ছাত্রলীগ ক্যাডার আনসার আহমদ ওরফে শুটার আনসার, ছাত্রলীগ ক্যাডার হাসান আহমদ, ২নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ হোসেন,শেখঘাট এলাকার যুবলীগ নেতা জন্টু, স্বেচ্ছাসেবকলীগ কর্মী বাবুল আহমদ পাঙ্গাস, মুনিম আহমদ, রনি তালুকদার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অস্ত্রধারীদের বেশিরভাগই ভারতে পালিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে দুই দেশের চিনি ও গরু-মহিষ, মাদক-অস্ত্রসহ চোরাকারবারীরা সীমান্ত পারাপারে তাদেরকে সহায়তা করেছে। এছাড়া তাদের সহযোগীতায় জৈন্তা, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলায় অনেক চোরাকারবারী রাতারাতি জিরো থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। ভারত হয়ে পরবর্তীতে কেউ যুক্তরাজ্যে ও কেউ দুবাই পৌঁছেছেন। কেউ কেউ আবার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন। আর যারা সীমান্ত পাড়ি দিতে পারেননি তারা সিলেট ছেড়ে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম কর্মকর্তা, অতিরিক্ত উপ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ভিডিও ও ছবি দেখে অস্ত্রধারীদের পরিচয় সনাক্তের কাজ চলছে। প্রদর্শিত অস্ত্রগুলো কোথা থেকে কিভাবে এসেছে বা কাদের হেফাজতে এগুলো ছিল- সেটাও উদঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি অস্ত্রধারীদের অবস্থান সনাক্ত করে তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টায় আছে পুলিশ।