জৈন্তাপুর (সিলেট) প্রতিনিধি //
সিলেটের জৈন্তাপুরের ঐতিহ্যবাহী সারী নদীতে অবৈধপন্থায় তিন কুতুবের নেতৃত্বে চলছে বালু উত্তোলন ও চাঁদাবাজি। সারাদেশে বাংলার নীল নদী নামে পরিচিত এই সারী নদী। আরেক নামে খ্যাত সর্ববৃহত বালু খনি হিসাবে। যার ফলে সরকার প্রত্যেকবছর নদীটি ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় করে থাকে। ২০১০ সনে লালাখাল চা-বাগান ও নাজিমগড় রির্সোট সারী নদীর উৎস মূখে কয়েকটি দাগের উপর মামলা করে। মামলার প্রেক্ষিতে পুরো সারী নদী হতে বালু উত্তোলনে সরকারি ইজারা বন্ধ হয়ে য়ায়। ফলে বেশ কয়েক বৎসর সারী নদীর ইজারা বন্ধ থাকে।
পরবর্তীতে স্থানীয় শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এবং রাজস্ব আদায়ের স্বর্থে সরকার মামলা ভূক্ত এরিয়া চিহ্নিত করে সারী নদীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে। সারীঘাট ব্রীজ হতে পয়োইনের মুখ পর্যন্ত (সারী-১), সারী ব্রীজ হতে কামরাঙ্গী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েরঘাট এরিয়া পর্যন্ত (সারী-২) এবং কামরাঙ্গী স্কুলঘাট হতে সারী নদীর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত (মামলা ভূক্ত এরিয়া) (সারী-৩) বিভক্ত করে।
রাজস্ব আদায় এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের কথা বিবেচনা করে সারী-১, সারী-২ ও বড়গাং নদী ইজারা প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করছেন। সারী-৩ মামলা ভূক্ত এরিয়া কোন প্রকার বালু পাথর উত্তোলন সংগ্রহ পরিবহন করা হতে শ্রমিকদের বিরত থাকতে নিষেদাজ্ঞা জারী করেন মাহামান্য আদালত।
সম্প্রতি একটি বালু ও পাথর খেকু চক্র সারী-৩ (মামলাভুক্ত) এরিয়া হতে জমে থাকা বালু পাথরের উপর লেলুপ দৃষ্টি পড়ে। তারা মহামান্য আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে শ্রমিকদের সহজে বালু সংগ্রেহর লোভ দেখিয়ে নিরিহ শ্রমিকদেরকে ভূল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে মামলা ভূক্ত (সারী-৩) হতে নৌকা প্রতি ৮শ' হতে ১হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে আসছে রহিম, সেলিম সহ আরও কয়েকজন। শ্রমিকদের কষ্ট কম হওয়ায় এবং স্টক বালু পাওয়ার কারনে একান্ত বাধ্য হয়ে চাঁদা দিয়ে বালু সংগ্রহ করেছে।
চাঁদা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে চাঁদা আদায়কারী ও বারকী শ্রমিকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে সারী-৩ হতে চাঁদাবাজী বন্দের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া আগষ্ট মাসে সরজমিন পরিদর্শন করেন। ঐসময় দুটি নৌকাসহ তিনশত ফিট বালু জব্দ করেন। কঠোর ভাবে আদালতের নিষেদাজ্ঞা পালনের নির্দেশনা জারী করেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর বালু ও পাথর খেকু চক্র প্রশাসনের নাম ভাঙ্গিয়ে সারী-৩ মামলাভূক্ত এরিয়া হতে পুনরায় বালুর বিনিময়ে বারকী শ্রমিকদের নিকট হতে ৮শ' থেকে ১হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করে আসছে।
এবিষয়ে সারী নদীর বালু শ্রমিক (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) জানান, আমরা নিরীহ শ্রমিক। পেটের দায়ে পানিতে বালতী ফেলে কিংবা ডুব দিয়ে বালু সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে ২শ' ফুট কিংবা আড়াইশত ফুট বালু সংগ্রহ করতে প্রায় তিনঘন্টা সময় ব্যয় হয়ে যায়। ফলে একনৌকার অধিক বালু সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এজন্য আমরা সময় বাঁচাতে একের অধিক নৌকা বালু উত্তোলনের জন্য একান্ত বাধ্য হয়ে আমরা চাঁদা দিয়ে সারী-৩ হতে বালু সংগ্রহ করি। ফলে প্রতিদিন ভোর হতে বিকাল তিনটার মধ্যে দুই হতে তিন নৌকা বালু সংগ্রহ করছি। এভাবে কয়েকশত নৌকা সারী তিন হতে বালু পাথর সংগ্রহ করছেন বলে তারা জানান। টাকা না দিলে সারী-৩ হতে বালু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়না। চাঁদা না দিলে তাদের উপর বালু খেকু চক্রের সদস্যরা হামলা চালায়।
অপর শ্রমিক জানান, এই চক্রকে টাকা দিলে তাদের কোন সমস্য হয় না। তাদের দেওয়া চাঁদা নাকি প্রশাসন সহ কতিপয় অসাধু হলুদ সাংবাদিকরাও পেয়ে থাকেন। তাই চাঁদা দিয়ে বালু সংগ্রহ করতে হয়। যেহেতু চাঁদা দিলেও সংশ্লিষ্ট কেউ আমাদের বাঁধাও দেয় না। তাই বাধ্য হয়েই ঝমেলা বিহীন ভাবে আমরা সারী-৩ হতে বালু আহরন করছি।
অপর আরেক শ্রমিক প্রতিবেদক'কে জানান, আপনারা শ্রমিক বেশে আমাদের সাথে আসুন দেখবেন বালু খেকু চক্রের সদস্যরা কিভাবে নৌকায় বালু উত্তোলনের আগেই চাঁদা আদায় করছেন। আগে চাঁদা দিতে হয় পরে নৌকা লোড করতে হয়। আমাদের দাবী সরকার হয়ত কঠোর ভাবে সারী-৩ হতে বালু উত্তোলন আহরণ বন্ধ করার জন্য। নতুবা সারী-১, সারী-২ ও বড়গাং নদীর ন্যায় ইজারা প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করলেও আমরা চাঁদাবাজীর কবল হতে মুক্তিপাব। এতে সরকার হারাবেনা রাজস্ব।
এবিষয়ে জানতে স্থানীয় একজন প্রবীণ মুরব্বী চাঁদাবাজ চক্রের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, এগুলো জেনে আর পত্রিকায় লিখে কি হবে। হয়ত দুই-এক দিন বন্ধ হবে, পরে আবারও চালু হবে। আপনারাও তাদের কাছে এই সেই হয়ে যাবেন। আপনাদের অনেক লোক সাইকেল গাড়ী নিয়ে আসেন এবং চা-পান সিগারেট খেয়ে আর ফি নৌকায় জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সময় কাটিয়ে চলে যাবেন। টাকার বিনিময়ে জিরো পয়েন্ট হতে বালু পাথর সংগ্রহ হচ্ছে। এসব বন্ধ হয়নি আর হবেওনা। তিনি আরও বলেন, সারী-৩ মামলা দিয়ে বন্ধ থাক সবাই চাচ্ছে। তারা কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা মিলে মিশে খাবে। তিনি আরও বলেন প্রশাসন অভিযানে আসার পূর্বেই চক্রের সদস্য সহ সবাই লাপাত্তা হয়ে যায়। আই ওয়াশের জন্য দুই একটি নৌকা রাখা হয় মাত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১ বছরে সারী ৩ হতে নিরিহ শ্রমিকের পেটে লাত্তি মেরে ৮০০ টাকা হারে ১১ কোটি টাকার চাদাঁবাজী হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক জনপ্রতিনিধি বলেন, গরিব মানুষ শ্রমিক যদি সারী ৩ হতে বালি পাথর আরোহন করে তবে চাঁদা দিবে কেন? চললে ফ্রি চলবে না হয় চাঁদাবাজি বন্ধ হবে।
চাঁদাবাজির ব্যাপারে জানতে রহিমের মুটোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এটা ষোল আনা মিথ্যা কথা। তিনি বলেন, মৌরসী যায়গা থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সেখান থেকে মাত্র ১শ' টাকা করে শ্রমিকদের জন্য চাঁদা তোলা হয়। এসময় তিনি দাবি করেন সোহেল বিল্ল্যাহ এক ব্যক্তি নামে ইজারা নিলে তিনি সেই স্থান থেকে বালু উত্তোলন করেন। তিনি কথার একপর্যায় নিজেকে অসুস্থ্য দাবি করে বলেন, দীর্ঘ প্রায় তিনমাস থেকে ঢাকায় অবস্থান করে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এঘটনায় তার কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এ ব্যাপারে শামছুজ্জামান সেলিম মুঠোফোনে বলেন, বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এর আগে শ্রমিক নেতা আমীর আলীর নেতৃত্বে বালু উত্তোলন করা হয়। এসময় তিনি বলেন, সারী ৩ নং- এলাকায় মহামান্য আদালতের মামলা রয়েছে সেখানে কোন বালু উত্তোলনের সূযোগ নেই। তিনি দাবি করে বলেন, ঐ এলাকায় বালু উত্তোলন বন্ধে তিনি নিজেও চেষ্টা করেন কিন্তু তার কথা কেউ কর্ণপাত করতে রাজি নয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকজন শ্রমিক আমাকে জড়িয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শুনেছি কিন্তু আর কিছু আমার জানা নেই। অপরদিকে শ্রমিক নেতা আমীর আলীর সহীত শত যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি বিধায় তার কোন বক্তব্য মিলেনি।
এনিয়ে কথা বললে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, সারী ৩ সম্পর্কে আমি বার বার ভিজিট করেছি যদি অবৈধ ভাবে কোন উৎকোচ কেহ আদায় করে তবে উপজেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহন করবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে বর্তমানে সারী ৩ হতে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। তবে আগামী শনিবার থেকে পুনরায় বালু উত্তোলন করতে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে।
Editor and Publisher : Nityananda Sarkar,
News Editor- Arun Sarkar.