খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি প্রতিবেদক //
খাগড়াছড়িতে গত বৃহস্পতিবার রাতে সংঘটিত সহিংসতার পর শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাঙ্গামাটিতেও পাহাড়ি-বাঙালি দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ৪ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে তিনজন নিহত ও ২০ জন আহত এবং রাঙ্গামাটিতে একজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা গুরুতর।
ঘটনার পর খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে দুপুর থেকে শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। অপরদিকে সহিংস ঘটনার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ শনিবার থেকে ৭২ ঘণ্টার সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর পাশাপাশি দোকানপাট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহও বন্ধ রয়েছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সকল মহলকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের সরকারি একটি প্রতিনিধি দল আজ খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পরিদর্শনে যাচ্ছে।
জানা গেছে, চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক যুবককে বুধবার সকালের দিকে জেলা সদরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব সহিংসতায় শুক্রবার রাত পর্যন্ত ৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরও ২০ জন। এর মধ্যে ৭ জনকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ৪ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও পৌর শহরে শুক্রবার বেলা দুইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
পুলিশ জানায়, দীঘিনালায় নিহত ব্যক্তির নাম ধনরঞ্জন চাকমা (৫০)। তিনি দীঘিনালার কান্দারা চাকমার পুত্র। বৃহস্পতিবার দীঘিনালায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। নিহত অপর দুজন হলেন রুবেল ত্রিপুরা (১৯) ও জুরান চাকমা (২০)। রুবেল খাগড়াছড়ি জেলা সদরের জামিনি মোহন চাকমার পুত্র। জুরান চাকমা খাগড়াছড়ির নারানখাইয়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে প্রাণ হারান।
খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রিপল বাপ্পি চাকমা নিহতের লাশ হাসপাতালে আছে বলে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এদের মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। অপর দুইজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান।
এদিকে শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক মো. শহীদুজ্জামান, দীঘিনালা সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল ওমর ও পুলিশ সুপার আরিফিন জুয়েল দীঘিনালার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন ও ঘটনার তদন্তে কমিটি গঠনসহ দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের আশ্বাস দেন। তিনি ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও দীঘিনালা এবং পানছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তা অবরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চড়াও হয়। পানছড়িতে বিক্ষোভকারীরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।
রাতে জেলা সদরের নারানখাইয়া ও স্বনির্ভর এলাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা যায়। হাসপাতালে চিকিসাধীন আহত ও তাদের অভিভাবকরা জানিয়েছেন, জেলা সদরের নারানখাইয়া এলাকায় কয়েকজনকে আটক করলে তারা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলিবর্ষণ করলে তারা গুলিবিদ্ধ হন।
বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে জনমনে আতঙ্ক ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে উত্তেজিত পাহাড়ি লোকজন রাস্তায় গাছ কেটে এবং চেঙ্গী নদীর জন্য নির্মিত ব্লক ফেলে রাস্তা অবরোধ করে। ফলে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা ও পানছড়িতে নিরাপত্তাবাহিনীকে টহল দিতে দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দীঘিনালা সেনা জোনের জোন কমান্ডার লে. কর্নেল ওমর জানান, পুরো জেলার পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। রাস্তায় রাস্তায় সেনা টহল রয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিজের হাতে আইন তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শীঘ্রই আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান।
এদিকে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের মিছিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালি দুইপক্ষের সংঘর্ষে শুক্রবার একজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়, ব্যাংক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, তেলের পাম্প ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর হয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এ সময়ে দুর্বৃত্তরা শহরে বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল অটোরিক্সাসহ ২০-২৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা শহরের বনরূপা, হ্যাপিরমোড়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেসহ কয়েকটি স্থানে এসব হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এতে অন্তত একজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ব্যাপক সংঘর্ষের পর থেকে রাঙ্গামাটি শহরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে রাঙ্গামাটি শহরের জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গণ থেকে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলটি বনরূপায় এলে কিছু দুর্বৃত্ত শহরের সড়কের পাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরে ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের পর সেনাবাহিনী আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে দুর্বৃত্তরা এ সময় কয়েকটি দোকান ও বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই সময় অন্তত ১৫-২০টি দোকান ভাঙচুর করা হয়।
রাঙ্গামাটি শহরে জানমাল নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান শুক্রবার দুপুর থেকে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। তবে পরিস্থিতি থমে থমে রয়েছে।
রাঙ্গামাটি কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ আলী জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এর আগে বুধবার ভোরে খাগড়াছড়ি পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পানখাইয়া পাড়ায় এক পাহাড়ি বাড়িতে মোটরসাইকেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন মো. মামুন (৩০) নামে এক যুবক এ সময় তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত মামুন খাগড়াছড়ির মধ্য শালবাগান এলাকার মৃত নূর নবীর ছেলে। এ ঘটনার জন্য পানখাইয়া পাড়াবাসীকে দায়ী করেছেন মামুনের স্বজনরা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই মিছিলকে ঘিরেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। দীঘিনালায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় অনেক জায়গায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। লারমা স্কয়ারে অন্তত ৮০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ ঘটনার জেরে রাঙ্গামাটি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনায় শুক্রবার বান্দরবান সদরে বিক্ষোভ মিছিল এবং প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সম্মিলিত উপজাতি ছাত্র সমাজ। বেলা ১১টায় বান্দরবান সদরের রাজার মাঠ এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ট্রাফিক মোড়ে গিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। এ সময় বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অংশৈসিং মারমার সভাপতিত্বে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রকল্যাণ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বিটন তঞ্চঙ্গ্যা, টনয়া ম্রো, জন ত্রিপুরা, মাখ্যাই মারমা, হিরো খেয়াং এবং হালেলুই বম প্রমুখ।
এতে বক্তারা বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সদর এলাকায় মামুন নামে এক ব্যক্তি মোটরসাইকেল চুরি করে পালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হন। এ সময় স্থানীয় জনতা তাকে গণধোলাই দেয়। পরে মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীঘিনালা সরকারি কলেজের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে। আর কিছু বিক্ষুব্ধ পাহাড়িদের দোকানপাটে হামলার চেষ্টা করে। পরে সাম্প্রদায়িক হামলায় রূপ নেয়। এতে অর্ধশতাধিক পাহাড়িদের দোকান ও বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বক্তারা এ হামলার প্রতিবাদে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচারের দাবি জানান তারা।