ছবি-সংগৃহীত।
বিশেষ প্রতিবেদক //
ন্যাশনাল টি কোম্পানির সচিব মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ বছরের পর বছর ধরে নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন। এনটিসি’র কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি যাদের সহযোগিতায় করা হতো তাদের একজন হলেন কোম্পানী সচিব মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ। আরও ছিলেন কোম্পানীর অর্থকর্তা কেরামত আলী।
২০২৪ সালের শুরুতে ওই সিন্ডিকেটে যোগ দেন ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ মাহমুদ হাসান। তারা এখনো রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এনটিসি‘র চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা। কোম্পানীর কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ সকল কাজ করতেন মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ, কেরামত আলী ও শাহাদাৎ হোসেন। চেয়ারম্যানের জ্ঞাতসারে আবার কখনো অজ্ঞাতসারে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করে ফুলেফেঁপে ওঠেন মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ।
ন্যাশনাল টি কোম্পানীতে দুর্নীতি ও কোটি টাকার সিআইসিট ও রাসায়নিক মালামাল আত্মসাৎ-
ন্যাশনাল টি কোম্পানীর ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ৪০ লাখ টাকার সিআইসিট ক্রয় করা হলেও তা কোনো বাগানে সরবরাহ করা হয়নি। অডিট প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই যার জন্য দায়ী অডিটর মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ।
অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি বাগানের রেজিস্ট্রার বহি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে তা লুকিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া, পাত্রখোলা কেন্দ্রীয় গোদামে ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার ২১২ টাকার রাসায়নিক মালামাল মজুদ থাকা সত্তেও অডিট রিপোর্টে এ বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তীতে মোল্লা গোলাম মুহাম্মদকে বিশেষ অডিট তদন্তের আদেশ দেওয়া হলে তিনি রাসায়নিক দ্রব্য আত্মসাতের অভিযোগ উত্থাপন করেন। তিনি দায়ভার গোদামের দায়িত্বে থাকা ডিজিএম সৈয়দ মাহমুদ হাসানের উপর চাপিয়ে দেন এবং তাকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন। দুর্নীতির এই ঘটনার পরও, কতৃপক্ষ সৈয়দ মাহমুদ হাসানকে ভারপ্রাপ্ত এমডি পদে নিয়োগ দিয়েছে, যা কোম্পানির অর্ধকোটি টাকার রাসায়নিক মালামাল আত্মসাতের ঘটনা আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ এই দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি উঠেছে। শুধু তাই নয়, বাগানে উৎপাদিত ভাল মানের চা এক ডলারে এক কেজি ও ২৫.৫০ টাকা দরে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা বিক্রয়ের মুল হোতা মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ দায়ী। যদিও কোম্পানীর জন্য এটি আত্মঘাতি সিন্ধান্ত বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।ক্রেতা সালমান তালিব ৪২ লাখ টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন সচিবের আপন দুলাভাই তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ হলেন তার শ্যালক, আর এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি এনটিসিতে পদোন্নতি লাভ করেন। জেলা জজ কাজী গোলাম রসুলের এক মেয়ে নিশাত রসুল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিএস ছিলেন। এ সুবাদে মোল্লা গোলাম মোহাম্মদের ভাগ্য খুলে যায় এবং এনটিসিতে দাপটের সাথে পথ চলা শুরু হয়। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে পুরো সময়টি গোপালগঞ্জ জেলার কয়েক জন পরিচালকসহ মোল্লা গোলাম মোহাম্মদ ও কেরামত আলী মিলে মিশে কোম্পানির কোটি কোটি টাকা লুটেপুটে নিয়েছেন। সদ্য চাকুরীচ্যুত হওয়া অর্থ কর্মকর্তা কেরামত আলীর নের্তৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে উঠে ছিল। তারা সকলে মিলে এমন এক শাসন ব্যবস্তা প্রতিষ্টিত করেছিলেন, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার কাউকে একজন বিশেষ ব্যক্তির কাছেই কেবল জবাবদিহি করতে হতো। আর সেই ব্যক্তি ছিলেন সমস্ত জবাবদিহির উর্ধ্বে। এরই অবসান করতে শেয়ারহোল্ডার ও অনৈতিকভাবে চাকুরীচ্যুত হওয়া কর্মকর্তারা বিগত ১১ ও ২২ আগষ্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ও হেড অফিসের সামনে মানববন্ধন করেন। এরই ফলস্বরূপ ১৪ আগষ্ট শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দুর্দান্ত প্রভাবশালী ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটপাটকারী চৌধুরী নাফিজ সরাফতসহ ৬ জন পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৫ই আগষ্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার আগে তথাকথিত চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ভাবতে শুরু করেছিলেন এরকম ভাবে বছরের পর বছর ক্ষমতা ভোগ করতে থাকবেন। বিগত সাত বছরে কোম্পানী কয়েকশ' কোটি টাকা লোকসান করেছিল। শুধুমাত্র গত বছরই ৬৮ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়েছে এনটিসিকে। এমন অবস্তায় দুইজন সাংবাদিক ও এ কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডার দুনীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন চেয়ারম্যান পদে থাকার কারনে এনটিসির পরিবর্তন করা যাবে, এমন ভাবনা দুই সাংবাদিক ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভুক্তভোগীদের মানববন্ধন ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। একই সাথে অন্য কোন পথ খোলা ছিল না তাদের পদত্যাগ ছাড়া। অবশেষে এ কোম্পানীর প্রধান দুর্নীতিবাজ কেরামত আলীকে ২৪ সেপ্টেম্বর ৬৭৬ তম বোর্ড মিটিংয়ে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। এনটিসির পরিচালনা পর্ষদের ৬ জনের সিন্ডিকেটের ও তাদের প্রধান সহযোগী কেরামত আলীকে এনটিসি থেকে বিদায় দিতে চাইলেও বিশেষ কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চায়নি মানববন্ধনকারীরা বরং শাসন ব্যবস্তার সংস্কার চেয়েছে তারা।এনটিসির চেয়ারম্যান পদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্তৃত্বের অবসান করা।
২০১৫ সালে মোল্লা গোলাম মুহাম্মদকে এনটিসির সহকারী ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তার এই পদোন্নতির পেছনে কাজী গোলাম রসুলের প্রভাব ছিল বলে জানা গেছে। ২০১৪ সাল থেকেই তৎকালিন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে একের পর এক অনুরোধ জানিয়েও জীবদ্দশায় জেলা জজ গোলাম রসুল শ্যালক মোল্লা গোলাম মোহাম্মদের পদোন্নতি দেখে যেতে পারেন নি। পরবর্তিতে বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সির পিএস মাসুকুর রহমানের সাথে সর্ম্পকের সুত্র ধরে চরম দাপটে ছিলেন। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদের মামা হতেন বানিজ্যমন্ত্রীর পিএস মাসুকুর রহমান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিএস নিশাত রসুলের অতি পরিচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফতকে মোল্লা গোলাম মোহাম্মদের সাথে পরিচয় করে দেন। নিশাদ রসুল ও মোল্লা গোলাম মোহাম্মদের সক্রিয় সহযোগিতায় ইনভেষ্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) থেকে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে ২ লাখ ৭৬ হাজার এনটিসির শেয়ার কিনে পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে আসেন। মামা ভাগ্নীর সহযোগিতায় দুই পরিচালককে নিয়ে আসার পর থেকে মোল্লা গোলাম মোহাম্মদের দাপট আরও বেড়ে যায়। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদের নেতৃত্বে কেনাকাটা ও লুটপাটে সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। সিন্ডিকেটের এমন ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি বেড়ে ৬৮ কোটি টাকা লোকসান হয়। কোন অভিজ্ঞতা নেই, চার্টারস সেক্রেটারীর যোগ্যতাও নেই, ৫ বছরের সেক্রেটারী পদে চাকুরীর অভিজ্ঞতার সনদ কিছুই তিনি দিতে না পারলেও কোম্পানীর সচিব পদে নিয়োগ পেয়ে যান। জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা ছিল, ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রী অথবা ডিগ্রীর পাশাপাশি ইন্সষ্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারীজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) সনদ প্রাপ্ত হতে হবে। স্বনামধন্য লিস্টেড কোম্পানীর সচিব হিসাবে ৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা ও কোম্পানী আইন, সিকিরিটিজ আইন, শ্রম আইনসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আইন, বিধিবিধান ও শেয়ার ব্যবস্তাপনা সর্ম্পকে অভিজ্ঞ হতে হবে। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদের ৫ দিনের অভিজ্ঞতাও নেই, সনদ নেই, তবুও তিনি রহস্যজনক ভাবে কোম্পানীর সচিব পদে নিয়োগ ভাগিয়ে নেন। এর পর থেকে তিনি ১২টি চা বাগানের ম্যানেজার এবং সহকারী ম্যানেজারদের উপর দাপট দেখিয়ে প্রতি বছর দুর্নীতির প্রতিবেদন উলট পালটসহ ও অডিটের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ন্যাশনাল টি কোম্পানীর ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ৪০ লাখ টাকার সিআইসিট ক্রয় বাবত মালামাল সরবরাহের আগেই টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। কিন্তু মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ প্রায়ই প্রতিটি বাগানে অডিটের কাজে যেতেন এবং বাগানে পৌছেই তিনি তার ব্যবহার করার জন্য ২/৩ হাজার টাকার ওষুধ কিনাতেন। খাবার দাবার ছিল সব কিছুই ডাবল। যা কোম্পানী খরছ বহন করত। ঢাকা থেকে আসা ও যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ক্লাসের ট্রেনের টিকেট করে দিতে হতো। শুধু কি তাই, বাগানে গরু কেনা বেচা এবং লালন পালন ছিল তার আরেক পেশা। প্রতি কোরবানি ঈদে এক ট্রাক বোঝাই করে গরু তিনি ঢাকায় নিতেন। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদের ভাগ্নি নিশাত রসুল, যিনি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, তার নাম ব্যবহার করে কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীদের ভয় দেখাতেন এবং প্রতিটি বাগান থেকে মাসোহারা আদায় করতেন এবং এখনো সে আইন বলবৎ রয়েছে। কোম্পানীর সচিব হিসেবে অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করলেও, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তিনি এই পদে আসীন হন, যা নিয়ে অনেক শেয়ারহোল্ডার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ নিজেকে পুঁজিবাজারের বিএসইসির কমিশনার তারিকুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতেন, যা তাকে কোম্পানীর পরিচালকদের বিশেষ সুবিধা পেতে সাহায্য করেছে। যদিও কমিশনার তারিকুজ্জামানকে অতি সম্প্রতি চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদ রাজনৈতিক খোলস পাল্টাতেও সিদ্ধহস্ত। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি সিলেট জেলার বিএনপি‘র জনৈক এক নেতার ভায়োডাটা নিয়ে বানিজ্য মন্ত্রনালয় ও বিএসইসিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়ে আসতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শেয়ারহোল্ডাররা মনে করেন, অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য মোল্লা গোলাম মুহাম্মদকে কোম্পানী সচিব পদে পদোন্নতিকে কোম্পানির স্বার্থবিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন এবং এ বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। মোল্লা গোলাম মুহাম্মদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
কোম্পানী সচিব মোল্লা গোলাম মোহাম্মদ ও ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ মাহমুদ হাসানের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেও তাদের কেহই ফোন ধরেন নি।
Editor and Publisher : Nityananda Sarkar,
News Editor- Arun Sarkar.