আন্তর্জাতিক ডেস্ক //
ইসরাইলকে ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। আর এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব ও ইরান। চির বৈরি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ করে তুলছে সৌদি আরব। এতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া রিয়াদ তেল আবিবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না, এমন ইঙ্গিতই দিয়েছে দেশটি। যা সৌদি আরবের অবস্থানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত চাপা পড়া শিশুদের ছবি, মৃত সন্তানের সামনে মায়েদের আহাজারি এবং ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য প্রবেশে ইসরাইলি বাধা দানের চিত্র—এসব কিছুই সৌদি আরবের নেতৃত্বকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইস্যুকে উপেক্ষা করা অসম্ভব করে তুলেছে।
সৌদি ব্যবসায়ী ও রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং নিওম প্রকল্পের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য আলি শিহাবি বলেন, গাজা যা করেছে, তা হলো—এই অঞ্চলে ইসরাইলের অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পিছিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, সৌদি আরব দেখছে যে, ইসরাইলের সঙ্গে যেকোনো সম্পর্ক গাজার ঘটনার পর থেকে ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। যদি না ইসরাইলিরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি না দেখায়—ইসরাইল ক্রমাগত এই দাবি অস্বীকার করছে—তাহলে এই অবস্থান খুব একটা বদলাবে না।
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব ও ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত ইসলামের প্রধান দুই ভাগের—সুন্নি ও শিয়ার মধ্যে লড়াই থেকে উদ্ভুত। আর হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুথি ইরানের সেই আধিপত্যের আকঙ্ক্ষারই ফসল।
এখন পর্যন্ত সৌদি আরব ও এর উপসাগরীয় মিত্ররা ইরানের কূটনৈতিক পদক্ষেপের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান। কারণ, ইরানের দুই তথাকথিত প্রক্সি হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সঙ্গে লড়াই করলেও অন্য প্রক্সি ইয়েমেনের হুথিদের অস্ত্র ও সমর্থন করে যাচ্ছে। আর হুথিরা একসময় সৌদি আরবের তীব্র বিরোধিতা করেছে।
আলি শিহাবি বলেন, ইরানিরা রিয়াদের প্রতি হাত বাড়ালে সৌদি আরব কখনো ফিরিয়ে দেবে না। আর ইরান যদি সত্যই আন্তরিক হয়, সেটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের সত্যিকারের পুনর্গঠন।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর তরুণরা প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের নির্মম চিত্র দেখে ইসরাইল সম্পর্কে তাদের মনে যতটুকুও বা ইতিবাচক, নিদেনপক্ষে দ্ব্যর্থক মনোভাব ছিল সেটুকুও ঘৃণায় রূপ নিয়েছে। যেখানে এই অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যার একটা বড় অংশই তরুণ। ২০২২ সালে সৌদি আরবের নাগরিকদের গড় বয়স ছিল ২৯ বছর।
এদিকে গাজার পরিস্থিতি এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সৌদি যুবরাজ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ওকালতি করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার উপদেষ্টা পরিষদে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, ‘সৌদি আরব পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত প্রচেষ্টা বন্ধ করবে না এবং আমরা নিশ্চিত করছি যে, সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে এটি ছাড়া কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না।’
ইউএস স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে তিনি একই ধরনের ভাষণ দিয়েছিলেন।
মাত্র এক বছর আগেও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল সৌদি আরব। যা মূলগতভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই বদলে দিতে পারত। একই সঙ্গে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানকে একঘরে করে ফেলতো অনায়াসে। পাশাপাশি, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রশ্ন নিয়েও কোনো কথা উঠত না জোরালোভাবে।
কিন্তু বর্তমানে সৌদি আরব–ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি অতীতের যেকোনো সময়ের বিবেচনায় সুদূর পরাহত। যদিও হামাসের প্রধান ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে হত্যার পর গাজায় একটি যুদ্ধবিরতির আশা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এরপরও বিষয়টি আর ইসরাইলের পক্ষে যাচ্ছে না।
এ ছাড়া ভারত মহাসাগরে যৌথ নৌ-মহড়া শুরু করেছে ইরান, রাশিয়া ও ওমান। এতে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকছে— সৌদি আরব, ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, কাতার ও বাংলাদেশ।
স্পষ্টত, মধ্যপ্রাচ্যে একটি কূটনৈতিক দাঁতাত (উত্তেজনা প্রশমন প্রক্রিয়া) চলমান। কিন্তু ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেমনটা পরিকল্পনা করেছিলেন, এই দাঁতাত তার ধারে-কাছেও নেই।
নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, তার দেশ রিয়াদের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চায়। কিন্তু সম্প্রতি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সাক্ষাৎ করেছেন, যা ইতিহাসে প্রথম।
এই পরিবর্তন নড়বড়ে হলেও ইরানের সঙ্গে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈরিভাব দূর করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই বৈরিতার কারণে এই অঞ্চলে বিগত কয়েক দশকে যে রক্তপাত হয়েছে তা বন্ধ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হাজির করেছে এটি।
কেবল উপসাগরীয় দেশগুলো নয়, সৌদি আরবও সফর করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। সফর করেছেন ইরাক ও ওমানে। ফলে দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমন সম্ভব হতে পারে। এর বাইরে তিনি, জর্ডান, মিশর ও তুরস্ক সফর করেছেন। বিগত ১২ বছরের মধ্যে এ–ই প্রথম কোনো ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশর সফর করলেন।
গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তুরস্ক সফরকালে ইস্তাম্বুলে বলেন, এই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি, গাজা–লেবাননের যুদ্ধ এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের বিষয়ে এখন আমাদের একটি সাধারণ অভিযোগ আছে।
এতে স্পষ্ট যে, এই ইস্যুগুলোতে তিনি যেসব দেশ সফর করেছেন তাদের অবস্থান একই না হলেও খুবই কাছাকাছি।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যখন বারবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি অস্বীকার করছেন, তখন সৌদি আরব গণমাধ্যম এবং কূটনৈতিক ফোরাম সব জায়গাতেই এই ইস্যুকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বলেছে, ইসরাইল যদি আমাদের পাশে পেতে চায় তাহলে একমাত্র পথ হলো— ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
কেন উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে জোর দিচ্ছে ইরান?
পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন, ইসরাইলি হামলা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হিজবুল্লাহর বেশিরভাগ শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করেছে বলেই হয়তো সময়ক্ষেপণের জন্য এই কাজ করছে। কারণ, লেবাননের এই মিলিশিয়া বাহিনী দীর্ঘকাল ধরে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আরব মিত্র ও প্রক্সি।
দীর্ঘদিন গোষ্ঠীটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে ও মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের শক্তি প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার। হিজবুল্লাহ ইরানের পক্ষ থেকে বেশ ভালোই ধাক্কা দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলকে। এই অঞ্চলে হিজবুল্লাহ ছাড়া তেহরান মারাত্মকভাবে দুর্বল।
গাজায় চলমান যুদ্ধ আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকেও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি শুরু করতে বাধ্য করেছে। কারণ, তারাও নিজ নিজ জনমত নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত গত কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই সম্পর্কও ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে।
সেই চাপের কারণেই হয়তো আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ গত মাসে বলেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজা পুনর্নির্মাণের ভার ইসরাইলের কাঁধেও বর্তাবে।
তিনি বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া গাজা যুদ্ধের পরবর্তী পদক্ষেপ সমর্থন করতে প্রস্তুত নয়।
যদিও নেতানিয়াহু দাবি করেই চলেছেন, রিয়াদের সঙ্গে একটি স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরে কাজ করছে ইসরাইল। তবে সৌদি কর্মকর্তারা, দেশের জনমতের বিস্তৃত বিভাজনকে সামনে তুলে ধরে সেই বিষয়টিকে দৃষ্টির অগোচরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে আলি শিহাবি বলেন, আব্রাহাম অ্যাকর্ডস মূলত একটি চটকদার বিষয়। এতে বাস্তব, স্থায়ী আঞ্চলিক শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে তারা তা করেছে—কারণ, তারা ইসরাইলকে ওয়াশিংটনে প্রভাব বিস্তারের পথ হিসেবে দেখে।
তিনি বলেন, কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসরাইলের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ক্ষমতা বা প্রভাব নেই—যা খুবই অপমানজনক এবং ইসরাইলিদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কোনো ইচ্ছাই নেই।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস।