দ্য ডেইলিমর্নিংসান অনলাইন //
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে এবং সে কারণে মানব সভ্যতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মানুষ আত্ম-বিধ্বংসী মূল্যবোধের প্রচার করে যাচ্ছে।
তিনি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনে বিশ্বকে বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক ও তারুণ্যের শক্তিকে সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন, যা একটি নতুন পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে তিনটি শূন্যভিত্তিক তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন উপস্থাপন করে।
বুধবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ এর ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ প্রদানকালে তিনি এ পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বেঁচে থাকার জন্য, আমাদের আরেকটি সংস্কৃতি গঠন করতে হবে। একটি ভিন্ন জীবনধারার ওপর ভিত্তি করে আরেকটি পাল্টা সংস্কৃতি গড়তে হবে। এটি হবে শূন্য বর্জ্যরে ওপর ভিত্তি করে। এ সংস্কৃতি নিত্যপণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করবে, কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট রাখবে না।
‘ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’ শিরোনামে ১২ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান কপ-২৯ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার্ক, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুইজ্জো, আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইদিনামা, এন্টিগুয়া-বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী কেস্টন ব্রাউনি, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্স সাবা খালেদ আল মাহমুদ আল সাবা, ভিয়েতনামের প্রতিনিধি পিয়েট্টো প্যারোলিন, চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী পিটার বেইলা, ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিনা আনসারি হামজানিসহ প্রায় ৯০ দেশের সরকারপ্রধানরা বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যের শুরুতে ড. ইউনূস জলবায়ু দুর্যোগকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণে তুলে ধরার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জলবায়ু দুর্যোগ সমাধান থেকে শুরু করে অন্যান্য বিপর্যয় থামানোর দিকে নিয়ে যাবে। এটি একটি বড় কাজ, যাতে অনেক বড় বড় প্রশ্ন আসে। ‘তিন শূন্যের’ নতুন পৃথিবী গড়তে আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আপনাদের কাছে পেশ করতে চাই।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে জলবায়ু সংকট আরও তীব্র হওয়ার দিকটিও সম্মেলনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের সভ্যতা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ আমরা আত্ম-বিধ্বংসী মূল্যবোধ প্রচার করছি। একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক এবং তারুণ্যের শক্তিকে একত্রিত করতে হবে; একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান সভ্যতা তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা এই গ্রহের মানব সন্তানরাই গ্রহের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছি এবং আমরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করছি। আমরা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছি, যা পরিবেশবান্ধব নয়। আর এর পেছনে যুক্তি হিসেবে আমরা অর্থনৈতিক অবকাঠামোর কথা বলি, যাকে দিন-রাত, সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মতোই প্রাকৃতিক একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অথচ এই অর্থনৈতিক কাঠামো সীমাহীন ভোগের ওপর নির্ভরশীল। আপনি যত বেশি ভোগ করবেন, তত বড় হবেন। আপনি যত বড় হবেন, তত বেশি উপার্জন করবেন। সর্বোচ্চ মুনাফা আয়ই এই কাঠামোর ভিত্তি, যার মাধ্যমে এর ভেতর সবাই তাদের ভূমিকা পালন করে।
টিকে থাকতে হলে আমাদের ভিন্ন সংস্কৃতি, জীবনধারা তৈরি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি একটি ভিন্ন জীবনধারার প্রস্তাব পেশ করেন।
তিনি বলেন, এই জীবনধারা শূন্য বর্জ্যরে ওপর ভিত্তি করে হবে। আমরা প্রয়োজনীয় চাহিদার মধ্যে খরচ সীমাবদ্ধ রাখব, কোনো বাড়তি বর্জ্য রাখব না। এই জীবনধারা হবে শূন্য কার্বনের ওপর ভিত্তি করে। কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি থাকবে না। থাকবে শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এরপর, আমাদের এমন এক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে যা প্রাথমিকভাবে শূন্য ব্যক্তিগত মুনাফা, অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে।
প্রধান উপদেষ্টা এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, এই ব্যবসা অলাভজনক, যা সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। সামাজিক ব্যবসার একটি বড় অংশ মানব সম্প্রদায় ও পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করবে। সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে মানুষের জীবন রক্ষা পাবে ও গুণগতভাবে উন্নত হবে। এখানে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ থাকবে। নতুন শিক্ষার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি নেবে তারা। আমাদের চাকরিপ্রার্থী তৈরি করা শিক্ষাব্যবস্থার বদলে উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আত্মরক্ষাত্মক ও আত্ম-শক্তিবর্ধক একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক ও যুব শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা, এই গ্রহের মানব বাসিন্দারা এই গ্রহের ধ্বংসের কারণ। মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করছে এবং তারা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছে যা পরিবেশের বিরুদ্ধে কাজ করে। তারা এটিকে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো দিয়ে ন্যায্যতা দেয়, যা এই গ্রহ ব্যবস্থার মতো প্রাকৃতিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি আরও বলেন, এই অর্থনৈতিক কাঠামো সীমাহীন খরচের ওপর ভিত্তি করে চলছে। আপনি যত বেশি ব্যবহার করবেন তত বেশি প্রবৃদ্ধি পাবেন। যত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন, তত বেশি অর্থ উপার্জন করবেন। সর্বাধিক মুনাফা অর্জনকে সিস্টেমের সবকিছুকে আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভূমিকা পালনের শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, পরিবেশের নিরাপত্তার জন্যই একটি নতুন জীবনধারা তৈরি করা প্রয়োজন। সেই জীবনধারা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না, বরং মানুষ স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করবে। তরুণরা এই জীবনধারাকে পছন্দ করে। প্রতিটি তরুণ শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে শূন্য সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ এবং নিজেদের উদ্যোক্তায় পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব নিয়ে বেড়ে উঠবে। প্রতিটি ব্যক্তি তিন শূন্যের ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে এবং সারা জীবন তিন শূন্যের ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকবে। এভাবেই একটি নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে।
এরকম একটি সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব বলে আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস। তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, ‘আমি আশা করি আমার এই স্বপ্নে আপনারা সবাই যোগ দেবেন। আমরা যদি একসঙ্গে স্বপ্ন দেখতে পারি, তাহলে এই স্বপ্ন সত্য হবেই।’
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, কপ-২৯-এ যোগ দিতে সোমবার সন্ধ্যায় বাকুতে পৌঁছেন প্রধান উপদেষ্টা। ১৪ নভেম্বর তাঁর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
Editor and Publisher : Nityananda Sarkar,
News Editor- Arun Sarkar.