ছবি-সংগৃহীত।
সিলেট প্রতিনিধি //
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় গ্যাসফিল্ড কর্মকর্তা ময়নুল হোসেন আয়ানীকে (৫৫) ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যার’ পর সড়ক দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হয়েছিল। দুর্ঘটনায় মৃত্যু ধরে নিয়ে মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করেছিল পরিবার। হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর একটি ঘটনায় মৃত্যুরহস্যের মোড় ঘুরে যায়।
ময়নুল হোসেনের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর স্থানীয় একটি মসজিদের বৈঠকে এক যুবক ‘অপরাধবোধ’ থেকে স্বীকার করেন, তিনিসহ কয়েকজন মিলে ময়নুল হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছেন। এরপর এ ঘটনায় হত্যা মামলা করে পরিবার। দাফনের প্রায় চার মাস পর গতকাল রোববার দুপুরে ময়নুলের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে তোলা হয়। ময়নুল হোসেন সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের উপব্যবস্থাপক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত উমনপুর গ্রামের বাসিন্দা। ১৩ জুন রাত ১১টার দিকে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে তিনি নিহত হন। সে সময় জানা গিয়েছিল, পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় জৈন্তাপুর উপজেলার ৬ নম্বর চিকনাগুলের উমনপুরের (গ্যাস ফিল্ড ৮ নম্বর কূপ) সামনে মইনুল নিহত হন। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না করায় তামাবিল হাইওয়ে পুলিশের সহকারী শহর উপপরিদর্শক (এটিএসআই) হিজম পবিত্র সিংহ বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনা উল্লেখ করে মামলা করেন।
উমনপুর গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৮ জুন লিচু চুরির একটি ঘটনা নিয়ে স্থানীয় মসজিদে গ্রামের মানুষ আলোচনায় বসেন। সেখানে একই গ্রামের ইউসুফ আলী (২২) নামের এক যুবক নিজের ‘অপরাধবোধ’ থেকে ময়নুল হোসেনকে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা স্বীকার করেন। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও তিনজনের নামও তিনি বলেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, উমনপুর গ্রামের বাসিন্দা আজাদ খানের বাড়ির লিচু চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। আজাদ খানের বাড়িতে বেশ কয়েকটি লিচু গাছ থেকে লিচু চুরি হয়েছিল। সে সময় হাতেনাতে একই গ্রামের উমর আলী (২২), সোহেল আহমদ (২২) ও ইউসুফ আলীকে (২২) আটক করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই তিনজন আজাদকে উল্টো হুমকিধমকি দেন। পরে আজাদ খান এ নিয়ে গ্রামে সালিস ডাকেন। সেখানে জোরালো ভূমিকা রাখেন ময়নুল হোসেন। সালিসে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত হননি। তাঁদের বারবার উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। সালিসে ১৪ জুন শুক্রবার জুমার নামাজের পর পরবর্তী বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এর আগে ১৩ জুন রাতে ময়নুল হোসেনকে খুন করা হয়। লিচু চুরির ঘটনা সালিসের জন্য ২৮ জুন জুমার নামাজের পর বৈঠক হয়। সে বৈঠকে অভিযুক্ত ওই তিনজনকে হাজির থাকার কথা বলা হলেও তাঁদের মধ্যে শুধু ইউসুফ আলী উপস্থিত হন। বৈঠকের একপর্যায়ে ইউসুফ আলী ময়নুল হোসেনের খুনের ঘটনার বর্ণনা দেন। এরপর এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ইউসুফ আলীকে মারধর করতে উদ্যত হলে স্থানীয় মুরব্বি, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে ইউসুফকে তাঁর স্বজনদের জিম্মায় দেওয়া হয়।
ইউসুফ আলীর স্বীকারোক্তির পর নিহতের ভাই নাজমুল হোসাইন গত ৭ জুলাই আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন। আদালত গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলা রেকর্ড করার আদেশ দেন। আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ অক্টোবর জৈন্তাপুর থানায় মামলা রেকর্ড হয়। মামলায় উমনপুর গ্রামের উমর আলী (২২), সোহেল আহমদ বারেক (২২), ইউসুফ আলী (২২), সুবেদ আলী (২১), হরমুজ আলী (৪২), মোহাম্মদ আলী (৪২), মরম আলী (৬০), তাহের আলী (৪৫) ও সমসুর ইসলামকে (৫৪) আসামি করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশের করা সড়ক পরিবহন আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তামাবিল হাইওয়ের থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইউনুস আলী সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়; বরং ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনা সাজানো হয়েছে বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। ইউনুস আলী বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে মামলা করতে না চাওয়ায় পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তদন্তেও বিষয়টি এসেছে যে দুর্ঘটনা নয় হত্যা। সে অনুযায়ী আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি হাইওয়ে পুলিশের আওতায় না হওয়ায় সে বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া যায়নি।
চিকনাগুল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক আহমদ ও নিহত ময়নুল একই গ্রামের বাসিন্দা। ফারুক আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, এলাকায় প্রায়ই ছোটখাটো চুরির ঘটনা ঘটছিল; কিন্তু জড়িত কাউকে আটক করা যাচ্ছিল না। আজাদ খানের বাড়িতে চুরির ঘটনায় হাতেনাতে আটকের পর ময়নুল হোসেন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যাতে আর অপরাধমূলক কাজে না জড়ান, সে জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। এর জেরেই পরবর্তী সালিসের তারিখের আগে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
ইউসুফ আলী মসজিদে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন নিশ্চিত করে ইউপি সদস্য ফারুক আরও বলেন, ইউসুফ আলী সবার নাম বলেছেন। কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, পরে তাঁরা কীভাবে পালিয়ে আসেন, কোথায় অবস্থান নিয়েছিলেন। বিষয়টি এলাকার অন্যান্য মুরব্বিও শুনেছেন। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে তাঁকে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ময়নুলের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে আজ সোমবার দুপুরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাঁর ভাই নাজমুল হোসেন বলেন, লাশটি আগের স্থানেই দাফন করার প্রক্রিয়া চলছে। ভাইয়ের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান তিনি।
জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেন, গ্যাসফিল্ড কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় হওয়া মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।সূত্র-প্রথম আলো।