স্টাফ রির্পোটার //
‘বর্তমানে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা পার্শ্ববর্তী দেশে বসে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করছেন। ওই ষড়যন্ত্রে সংখ্যালঘুরা যেন পা না দেয়, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে নিয়ে দেশ গড়তে হবে।’
শনিবার রজনীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
বক্তারা বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হিন্দুদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হয়নি। ১৯৯১ সালের ঘটনাসহ প্রতিটি ঘটনার ইন্ধনদাতা আওয়ামী লীগ। তাই আগামী দিনে সংখ্যালঘুরা যেন কোনো একটি রাজনৈতিক দলের খেলার পুতুল না হয়।’
তারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখনও বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। অথচ পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে তা করতে পারতো না। প্রতিনিধিত্বশূন্য হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবমান। ১৯৪৭ সালে এদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৩৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, এখন মাত্র ৭.৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০-২২ বছরে এদেশ হিন্দুশূন্য হবে।’
বক্তারা আরও বলেন, ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব দেয়নি। অন্যান্য দল থেকেও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব অনিশ্চিত। অর্থাৎ বলা যায়, আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বশূন্য থাকবে।’
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে বহির্বিশ্বে নিন্দার ব্যাপারে তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের মান-মর্যাদা, সব অর্জন সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে ধূলিসাৎ। হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস পেছনে ফেলে বাংলাদেশকে জঙ্গি, মৌলবাদী তকমা জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
ধর্ম অবমাননার অজুহাতে আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে বক্তারা বলেন, ‘অনুসন্ধানে জানা গেছে ১৯৯১ সালের ঘটনাসহ প্রতিটি ঘটনার ইন্ধনদাতা আওয়ামী লীগ। তাতে অন্যান্য দলের কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেছে। যে কারণে কোনো ঘটনারই বিচার করেনি কোনো দল।’
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন হয়েছে। তখন সংখ্যালঘু ভাই-বোনেরা নীরবে ওই অত্যাচার সহ্য করেন। তখন অন্যান্য সংগঠনগুলোকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখি। বাংলাদেশে গত ১৫ বছর হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কেউ নিরাপদ ছিল না। শুধুমাত্র আওয়ামী রাজনীতি, তাদের লুটপাট ও ভাগবাটোয়ারার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তারাই কেবল নিরাপদ ছিল। কারণ আওয়ামী লীগ জানে, বেশিরভাগ সংখ্যালঘু ভোট তাদের ঘরে যাবে। সুতরাং থাকলে ভোট, গেলে যোগী। এটাই তাদের মূলমন্ত্র ছিল।’
তিনি বলেন, ‘গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার পেয়ারের লোক বেনজির হিন্দুদের বিঘার পর বিঘা জমি দখল করে নিয়েছিল। তাদের কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। আওয়ামী লীগের ইশারা না থাকলে বেনজিরের পক্ষে ওই জায়গা দখল করা সম্ভব হতো?’
রুমিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বলতো, তারা ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে। শেখ হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশ ইসলামিস্টরা নিয়ে নেবে। কোনো সংখ্যালঘু নিরাপদ থাকবে না- এই মিথ্যাচার প্রমাণ করবার জন্য প্রথম দিন থেকে (৫ আগস্ট) ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা।’
হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা কোনো নির্দিষ্ট দলের খেলার পুতুল হবেন না। আপনার ভোট ভীষণ মূল্যবান। আমাদের যেন ভিক্ষা করে ভোট আনতে হয় আপনাদের কাছ থেকে। আমরা যেন আগেভাগে নিশ্চিত হয়ে না যাই, এই ভোট তো আমরা পাবই। তাদের বাড়িঘর, জমি দখল করলেও পাবো- এই যে তাদের আত্মবিশ্বাস! আমারে ছাড়া আর ভোট যাবে কই, এই জায়গাটা খুজে বের করেন। আপনার এলাকায় যে প্রার্থীকে আপনার ভালো লাগবে, তাকেই আপনি ভোট দেবেন। আপনার পাশে যারা দাঁড়াবে, তাদেরকে ভোট দেবেন। কোনো একটি দলের ভোট ব্যাংকে পরিণত হবেন না।’
ব্যারিস্টার রুমিন বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আমরা দেখলাম ফেসবুকে হঠাৎ করে পোস্ট আসে ধর্ম অবমাননায় পাড়ার পর পাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও যশোরে কোনো পুরুষও ঘরে থাকতে পারেনি। অভয়নগরে পূজায় হামলা হওয়ার পর আমি সেখানে গেলে হিন্দু নারীরা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে ভয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন। এভাবে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের হাতে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।’
আলোচনা সভায় মূলপ্রবন্ধে গোবিন্দ প্রামানিক বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশে ও বিদেশে যারা দেশকে মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী প্রচার করে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে, দেশকে অস্থিতিশীল করছে, তাদের কবর রচনা করতে চাই এবং তা সম্ভব হবে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি পুনরায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যানুপাতে আসন সংরক্ষণ করতে হবে। সারা দেশের প্রাপ্ত ভোট অনুসারে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সদস্য মনোনীত করবে। যাদের মধ্য থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা সরাসরি ভোটে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।’
সাংবাদিক সুজন দে’র সঞ্চালনায় ও বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট দ্বিনবন্ধু রায়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশ্রাফ আলী আকন ও যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান, বাংলা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী, শ্রীকৃষ্ণ সেবা সংঘের সভাপতি নকুল সাহা, দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার রাজীব আহমেদ, হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার পাল, সহ-সভাপতি দুলাল মন্ডল, তরুন ঘোষ, যুগ্ম মহাসচিব ডা. হেমন্ত দাস, সঞ্জয় ফালিয়া, বিশ্বনাথ মোহন্ত, হিন্দু মহাজোটের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা অ্যাডভোকেট প্রতীভা বাকচী প্রমুখ।
আপনাদের মূল্যবান মতামত প্রকাশ করুন।