স্টাফ রির্পোটার, মৌলভীবাজার //
জুলাই আন্দোলনের বীর সৈনিকদের একটি স্লোগান উচ্চারণ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। তাদের ক্ষোভটা ছিল সাড়ে ১৫টা বছর। এ সময়টায় তারা জাতির ঘাড়ে বসে সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। দেশটাকে শ্মশান কিংবা গোরস্তানে পরিণত করেছিল। এরা মাঝে মাঝে বলতো- দেশে নাকি অনাবিল শান্তি বিরাজ করছে। আমরা বলতাম, শান্তি তোমরা কায়েম করেছো কবরের মতো। যেখান থেকে হাসি কিংবা কান্নার শব্দ শোনা যায় না। কবরস্থানে কোন মানুষ থাকে না। হাসি কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না।
ডা. শফিকুর রহমান শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা জামায়াত আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
২৮ অক্টোবর তারা লাশের ওপর নর্দন করেছে উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, তখনই তারা জানান দিয়েছিল যে, ক্ষমতায় এসে খুন-গুমের রাজ্য কায়েম করবে। আমরা সেদিন আমাদের বুকের কান্না বাংলাদেশের মানুষের কাছে হয়তো বা পৌঁছাতে পারিনি। এরপর পেছনে বোঝাপড়া করে, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটি জঘন্য সরকারে হাত ধরে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তারা জয়লাভ করেছিল। ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে খুনের নেশা বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এরপর শুরু হলো তাদের তাণ্ডব। তারা প্রথম লক্ষ্যবস্তু করলো জামায়াতে ইসলামীকে, যারা পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক। জামায়াত সততা দিয়ে দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছিল। দক্ষতার সাক্ষর রেখেছিলেন। সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে ঠাণ্ডা মাথায়, মিথ্যা অভিযোগে, সাজানো কোর্ট, পাতানো সাক্ষী এবং ব্রাসেলস থেকে রায় এনে সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে খুন করা হলো। ফাঁসি দেওয়া হলো। কাউকে কাউকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো, জেলের ভেতর মৃত্যুবরণ করলেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা তখন আমাদের বন্ধু সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠনকে বলেছিলাম, এটি জামায়াতের ওপর আঘাত নয়। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই বিশাল দেওয়াল ভেঙে দিলে বাকীরা সবাই ভেসে যাবেন, কেউ টিকতে পারবেন না। আমাদের পাশে দাড়ান। ফ্যাসিজমকে সম্মিলিতভাবে আমরা মোকাবিলা করি। আমরা কথাগুলো কাউকে বুঝাইতে পারি নাই। সবাই মিলে একসঙ্গে সেই যুদ্ধটা করতে পারলাম না। তার পরের ইতিহাস আপনাদের সামনে পরিষ্কার। তারা আর কাউকে ছাড়লো না। এক এক করে সবাইকে ধরলো। বিএনপিকে ধরলো, হেফাজতকে ধরলো, আলেম ওলামাকে ধরলো, অন্যান্য দলকে ধরলো। কাউকে তারা ছাড় দিলো না। এমনকি এই যে সাংবাদিক বন্ধুরা আজকে এসেছেন নিউজ কাভার করতে; তাদেরকেও ধরলো। তাদেরকে খুন করলো, তাদেরকে আমাদের সঙ্গে গুম করলো। তাদের আয়নাঘরে পাঠালো। কাউকে কাউকে ওপারে বর্ডারে ভারতে নিয়ে ফেলে দিলো। এভাবে তারা গোটা দেশকে নরকে পরিণত করেছিল।
জামায়াত আমির উল্লেখ করেন, আজকে যুবকরা বলতেছে আমাদের ভোট চুরি করেছিল। তিনটা নির্বাচন!আজ যাদের বয়স ৩০/৩২ বছর তারা একটা ভোটও দিতে পারেনি। তাদের সমস্ত ভোটকে জেনোসাইড করেছিল, গণহত্যা করেছিল। ভোটের গণহত্যা। এদের নৈতিক সাহস ছিল না দেশে থাকার। এজন্য দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, জাতিকে এরা ৫৩ বছর বিভিন্ন কায়দায় ফ্যাসিজমের মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, মেজরিটি শক্তি, মাইনোরিটি শক্তি, কতভাবে যে ভাগ করেছে এরা। কারণ একটা জাতিকে যখন টুকরো টুকরো করা যায়, তখন তাদের গোলাম বানানো সম্ভব। এরা ধরে নিয়েছিল আমরাই দেশের মালিক, আমরা সবাই ভাড়াটিয়া। তবে হ্যাঁ, মালিকরাই দেশে আছে ভাড়াটিয়ারা পালিয়ে গেছে।
জামায়াত আমির এ সময় ভারতকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনারা শান্তিতে থাকেন। আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দেন। আপনাদের পাক ঘরে কি পাকাবেন আমরা জিজ্ঞেস করি না। আমাদের পাক ঘরে উঁকি মারার চেষ্টা করবেন না। নিজেরা আয়নায় চেহারা দেখুন। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবক দিতে হবে না।
তিনি বলেন, সাড়ে ১৫ বছর আমরা দফায় দফায় অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু সেই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারিনি। স্বৈরাচারকে আমরা তাড়াতে পারিনি, বিদায় করতে পারিনি। আমি গর্বিত আমাদের সন্তানেরা সেই কাজটি করেছে। আমি আমাদের সন্তানদের ভালোবাসা উপহার দিচ্ছি। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জাতির পক্ষ থেকে তাদেরকে স্যালুট জানাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আগামির বাংলাদেশ আমরা তাদের হাতেই তুলে দেবো।
এ সময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কেন? মৌলভীবাজার কি অপরাধ করেছে?
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এই জেলার কৃতি সন্তান একজন কৃতি অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তিনি সারা দেশকে সমান চোখে দেখতেন। আগামীবার একনেকে যেন মৌলভীবাজারে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ দিয়ে অন্য কোনো উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেই দাবি জানান।
জামায়াত আমির বলেন, মৌলভীবাজারে দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান। রাষ্ট্রীয় যথাযথ পর্যবেক্ষণ না থাকায় চা শিল্প ধ্বংস হওয়ার পথে। মালিক পক্ষ চায়ের যথাযথ মূল্য পান না। শ্রমিকরাও পারিশ্রমিক পান না।
মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা জামায়াতের আমির ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি মো. ইয়ামির আলীর পরিচালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন- কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম ও সিলেট জেলা আমির মাওলানা হাবিুবুর রহমান।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- হবিগঞ্জ জেলা আমির কাজী মাওলানা মুখলিছুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলার সাবেক আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম মতলিব ও মো. আবদুল মান্নান, মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহবায়ক ফয়জুল কবির ময়ুন, খেলাফত মজলিস নেতা অধ্যাপক মাওলানা আবদুস সবুর, মৌলভীবাজার জেলা নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রহমান, ছাত্রশিবির সিলেট মহানগর সভাপতি শরিফ মাহমুদ, পল্টন থানা জামায়তের আমির শাহীন আহমদ খান, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আমিনুল ইসলাম, ছাত্রশিবিরের মৌলভীবাজার শহর শাখার সভাপতি তারেক আজিজ, জেলা সভাপতি হাফেজ আলম হোসাইন, বড়লেখা উপজেলার সাবেক আমির মো. কমর উদ্দিন, মৌলভীবাজার পৌর আমির হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম, সদর উপজেলা আমির মো. ফখরুল ইসলাম, বড়লেখা উপজেলার আমির মো. এমদাদুল ইসলাম, রাজনগর উপজেলার আমির আবুর রাইয়ান শাহীন, কুলাউড়া উপজেলার আমির অধ্যাপক আব্দুল মুনতাজিম, জুড়ী উপজেলার আমির আব্দুল হাই হেলাল, শ্রীমঙ্গল উপজেলার আমির মাওলানা ইসমাঈল হোসেন ও কমলগঞ্জ উপজেলা আমির মো. মাসুক মিয়া।
সমাবেশ শেষে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান জেলার বিশিষ্টজন, সুধী ও পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
আপনাদের যে কোন মতামত সাদরে গ্রহণ করা হবে।